প্রকাশিত: ২৩/০৬/২০২০ ৪:৫৬ পিএম

মিয়ানমার পুলিশ খুঁজছে সাংবাদিক অং মার্ম ও’কে। আত্মগোপনে থাকা অবস্থায়ই নোবেল বিজয়ী অং সাং সুচির নেতৃত্বাধীন বেসামরিক সরকার নিয়ে ক্ষোভ উগড়ে দিলেন তিনি। অজ্ঞাত স্থান থেকে রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ডেভেলপমেন্ট মিডিয়া গ্রুপ নামে একটি সংবাদ সংস্থার প্রধান সম্পাদক মন্তব্য করলেন, ‘গণতন্ত্র ইতিমধ্যেই মৃত। তারা সংবাদমাধ্যমকে ব্লক করে দিয়েছে, সংবাদ সংস্থার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। সংবাদ নিষিদ্ধ করেছে, সাংবাদিককে সাজা দিয়েছে। একটি দেশের গণতন্ত্রের প্রাণভোমরা হলো গণমাধ্যম। গণমাধ্যম ছাড়া গণতন্ত্র কীভাবে বেঁচে থাকে?’

২০১০ সালে অং সাং সুচিকে গৃহবন্দিত্ব থেকে মুক্তি দেয় সামরিক জান্তা। তখন অং মার্ম ও ছিলেন নির্বাসনে থাকা ছাত্র অ্যাক্টিভিস্ট।

সু চি মুক্তি পাওয়ার পর আশা ফিরে পেয়ে দেশে ফিরলেন তিনি। শুরু করলেন সাংবাদিকতা। ২০১৬ সালে সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি ক্ষমতায় ফিরলো। অবসান হলো প্রায় অর্ধশতাব্দি ধরে চলমান সামরিক শাসনের। কিন্তু এখনও ক্ষমতায় ভীষণ প্রভাব সামরিক জেনারেলদের। সংবিধানে সামরিক বাহিনীকে ব্যাপক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। সংসদের ২৫ শতাংশ আসন সামরিক বাহিনীর জন্য বরাদ্দ থাকে।
সরকারের উপ তথ্যমন্ত্রী অং হ্লা তুন বলছেন, এই সরকার বিভিন্ন নির্যাতনমূলক আইন বন্ধ করেছে। তথ্য অধিকার আইন ও বিদ্বেষ-সূচক বক্তব্য বিরোধী আইন প্রণয়নের কাজ করছে।

তিনি বলেন, দেশের প্রথম গণতান্ত্রিক সরকার হওয়ায় এই সরকারের ওপর মানুষের আকাঙ্খা ছিল “অনেক বেশি ও অবাস্তবসম্মত।” তিনি বলেন, এর কারণ হলো আমাদের পূর্বসুরি সরকারগুলো আমাদের জন্য ব্যাপক চ্যালেঞ্জ রেখে গেছে।

এক ইমেইল বার্তায় তিনি বলেন, ‘মাত্র ৩-৪ বছরে নাটকীয়ভাবে সবকিছু পরিবর্তন করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।’ তিনি আরও যোগ করেন, সংবাদ মাধ্যম ও ক্ষমতা স্তম্ভের মধ্যে আস্থা ও সহযোগিতা সঞ্চার করার প্রয়োজন রয়েছে।

দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে সামরিক বাহিনী। সুশীল সমাজ ও সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা এখনও অনেক সীমিত জাতিগত সংঘাতে বিপর্যস্ত দেশটিতে।

সুচি’র সরকার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা থাকার ওপর গুরুত্বারোপ করেছে। ক্ষমতায় আসার পূর্বে সুচি সাংবাদিকদের সুরক্ষায় আইন প্রণয়নের কথাও বলেন। কিন্তু ক্ষমতায় এসে তার সরকার ৩১ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা থেকে শুরু করে ফৌজদারি মানহানি, নানা ধরণের অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। স্থানীয় মানবাধিকার সংস্থা আথান বলছে, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বেসামরিক সরকার নিয়ন্ত্রিত তথ্য মন্ত্রণালয় কয়েক ডজন সংবাদ ওয়েবসাইট ব্লক করেছে। এদের মধ্যে ডিএমজিও রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে ‘ফেক নিউজ’ ও ‘ভীতি সঞ্চার’ করার অভিযোগ আনা হয়েছে।

অনেক সংবাদ মাধ্যমেই মিয়ানমারের অভ্যন্তরের সংঘাত উপদ্রুত অঞ্চল যেমন রাখাইন ও শান অঙ্গরাজ্য নিয়ে সংবাদ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ডিএমজি’র সম্পাদক অং মার্ম ও’র বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে বেআইনিভাবে সম্পৃক্ত। মূলত, নিজের অঙ্গরাজ্য রাখাইনের বিদ্রোহী নেতাদের সাক্ষাৎকার প্রকাশের পর থেকেই তার বিরুদ্ধে ওই অভিযোগ আনা হয়। মামলায় অভিযোগ প্রমাণিত হলে তিনি ৩ বছর কারাদণ্ড পেতে পারেন।

রাখাইন মিয়ানমারের সবচেয়ে সংবেদনশীল অঞ্চলগুলোর একটি। এখানে সামরিক অভিযানের পর প্রায় সাড়ে ৭ লাখ মুসলিম রোহিঙ্গা সংখ্যালঘু বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। এখন আবার ভিন্ন ধরণের সংঘাত শুরু হয়েছে রাজ্যটিতে। এবার সরকারি বাহিনী ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী সংখ্যাগুরু রাখাইন অধ্যুষিত আরাকান আর্মির মধ্যে লড়াই চলছে।

এই বিধিনিষেধের মধ্যেও বহু বছর মিয়ানমারে কাজ করেছেন এমন ৪ জন স্বতন্ত্র সাংবাদিক রয়টার্সকে বলেছেন, সুচি ক্ষমতায় আসার পর তারা ভেবেছিলেন ছদ্মনাম ব্যবহার, আত্মগোপনে থাকা বা গোপনে ফুটেজ সংগ্রহ করার দিন বোধ হয় শেষ। কিন্তু এখন তারা সেই আগের মতোই কাজ করছেন।

সংবাদ প্রতিবেদন অব্যাহত রাখার জন্য ডিএমজি’র প্রতিবেদকরা তাদের প্রতিবেদন সরাসরি ফেসবুকে দেন। এছাড়া সংঘাত উপদ্রুত অঞ্চলের ফুটেজ পেতে সেখানে তারা গড়ে তুলেছেন নাগরিক সাংবাদিকদের একটি দলকে। এই নাগরিক সাংবাদিক নেটওয়ার্ক ব্যবহার করেই তারা সংঘাত এলাকার ফুটেজ সংগ্রহ করেন।

শাসক দল এনএলডির সদস্য ও দলীয় মুখপাত্রের সম্পাদক মন্যয়া অং শিন অবশ্য মনে করেন না যে দেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা কমেছে। তবে তিনি বলেছেন যে, রিপোর্টিং করার ওপর যেই বিধিনিষেধ ছিল তা এখনও রয়ে গেছে। তিনি স্বীকার করেছেন যে, সাংবাদিকদের প্রতি মানুষের চিন্তাভাবনা ঠিক করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তার মতে, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আগে তারা কেন আসলে সশস্ত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগ করেছে, তা আগে সরকারকে বুঝতে হবে।

অনলাইন ওয়েবসাইট ইরাওয়াড্ডি নিউজের রিপোর্টার লাওয়ি ওয়েং বলেন, মিয়ানমার নিয়ে বস্তুনিষ্ঠভাবে লেখার নিরাপদতম উপায় হলো দেশের বাইরে চলে যাওয়া। প্রায় ১০ বছর থাইল্যান্ডে থেকে দেশে ফিরেছিলেন ওয়েং। তিনি এখন বলছেন, ‘আমাদের চোখের সামনে একটি সংঘাত চলছে। কিন্তু আমরা এ নিয়ে রিপোর্ট করতে পারছি না।’

জান্তা সংস্কার শুরুর আগে মিয়ানমার বিশ্ব প্রেস স্বাধীনতা সূচকে একেবারে তলানিতে ছিল। ২০১০ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে দেশটির অবস্থান ২০ ধাপ উপরে উঠে। কিন্তু এরপর থেকে আবার কমতে শুরু করে। বর্তমানে ১৮০ দেশের মধ্যে এই সূচকে মিয়ানমারের অবস্থান ১৩৯।

এ সম্পর্কে উপ তথ্যমন্ত্রী অং হ্লা তুন বলেন, ‘আমার মতে, অন্যরা কী র‍্যাংকিং করলো, তার চেয়ে রিপোর্টাররা মাঠে গিয়ে কতটা স্বাধীন অনুভব করেন, তা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’ তিনি যোগ করেন, এই র‍্যাংকিং-এও থাইল্যান্ড ও বাংলাদেশের মতো প্রতিবেশী দেশগুলোর চেয়ে মিয়ানমারের অবস্থান ভালো।

২০১৭ সালে মিয়ানমারে রয়টার্সের দুই সাংবাদিকের গ্রেপ্তার বিশ্বজুড়ে ঝড় তুলেছিল। তারা তখন রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে হওয়া এক হত্যাযজ্ঞের ঘটনা তদন্ত করছিলেন। তারা অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট লঙ্ঘনের দায়ে আটক হন। ৭ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয় তাদের। তবে ৫০০ দিন থাকার পর প্রেসিডেন্টের ক্ষমায় তারা মুক্তি পান। মানবাধিকার সংস্থা আথান বলেছে, রাখাইনের সংঘাত নিয়ে প্রতিবেদন করায় অন্তত আরও ৪ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে।

সাংবাদিক নায় ম্যো লিনের ওয়েবসাইট আরাকান আর্মির এক মুখপাত্রের সাক্ষাৎকার প্রচার করে। তিনিও নির্বাসন থেকে দেশে ফিরে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ভয়েস অব মিয়ানমার (ভিওএম)। ওই সাক্ষাৎকার প্রচারের পর তাকে সন্ত্রাসবাদ-বিরোধী আইনে গ্রেপ্তার করা হয়। এই অভিযোগের সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবন। ১০ দিন পর জামিনে মুক্তি পেলেও এখনও বিপদে আছেন তিনি।

তিনি বলেন, ‘আমার স্ত্রীও একজন সাংবাদিক। সে পর্যন্ত বলছে যে আমার থামা উচিৎ। খুব বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে সবকিছু। আমাদের সব সঞ্চয় শেষ। আমি যে কাজ করি, তা থেকে ভালো কিছু হচ্ছে না।’

সুত্র: মানবজমিন

পাঠকের মতামত

ফিলিস্তিনপন্থি গ্রুপকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে ভোট দিয়েছেন টিউলিপ

যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টে প্রো-প্যালেস্টাইন কর্মসূচির সংগঠন ‘প্যালেস্টাইন অ্যাকশন’কে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আখ্যায়িত করে নিষিদ্ধ করার প্রস্তাবে ...

বৈশ্বিক অনুদান কমায় রোহিঙ্গা শিশুদের পড়ালেখার ক্ষতি হচ্ছে

বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে শিশু শিক্ষার পরিস্থিতি আরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান ...

যে কারনে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত ট্রাম্প

এবার ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি চুক্তির জন্য ট্রাম্পকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হয়েছে। পাবলিকান আইনপ্রণেতা ...